পারিবারিক নারী নির্যাতনের ঘটনা আমাদের সমাজে প্রতিদিন আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী/২০০৩) সহ আরোও অন্যন্য আইনে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠিন বিধান থাকলেও একজন নারীর সঠিক পদক্ষেপের অভাবে এ অপরাধের সঠিক বিচার করা সম্ভব হয়ে উঠেনা। আমাদের আজকের আলোচনা একজন নারী পারিবারিক নির্যাতনের স্বীকার হলে কি কি মামলা করতে পারবে সে বিষয় নিয়ে। একজন নারী কোন কোন আইনে কি ধরনের মামলা করতে পারবে তা নিন্মে আলোচনা করা হলোঃ
১। যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮ এর ৩ ধারাঃ
অত্র ধারায় বলা হয়েছে যদি বিবাহ পরবর্তীতে কোন এক পক্ষ অন্য পক্ষের নিকট সরাসরি বা যেকোনভাবে যৌতুক দাবী করেন তাহা হইলে অত্র ধারায় মামলা করা যাইবে। স্বামী স্ত্রীর বিরুদ্ধে কিংবা স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে উভয়েই এই ধারায় মামলা করতে পারবেন। এই ধারায় অপরাধ প্রমানিত হইলে আসামী কিংবা আসামীগন সর্বোচ্চ ৫ (পাঁচ) বছর ও সর্বনিন্ম ১ (এক) বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হইবেন এবং সর্বোচ্চ ৫০,০০০/- (পঞ্চাশ হাজার) টাকা পর্যন্ত যেকোন পরিমান অতিরিক্ত অর্থদন্ডে দন্ডিত হইবেন। অত্র ধারায় বিজ্ঞ চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে/ চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেট সংশ্লিষ্ট আমলী আদালতে আর্জি/ দরখাস্ত দাখিলের মাধ্যমে মামলা দায়ের করতে হয়। এবং উক্ত আদালতই অত্র মামলার বিচার করবেন।
২। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী/২০০৩) এর ১১ ধারাঃ
১১(ক) যৌতুকের দাবীতে মৃত্যু ঘটানোঃ
কোন নারীর স্বামী বা তাহার পরিবারের কোন সদস্য যদি যৌতুকের দাবীতে আঘাত প্রদানের মাধ্যমে মৃত্যু ঘটান তাহা হইলে অত্র ধারায় মামলা দায়ের করা যায়। অত্র ধারায় মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগ প্রমানিত হইলে আসামীগন মৃত্যুদন্ড, মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টার জন্য যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং উভয় ক্ষেত্রে উক্ত দন্ডের অতিরিক্ত অর্থদন্ডে দন্ডিত হইবেন।
১১(খ) যৌতুকের দাবীতে মারাত্বক আঘাত/ জখম করাঃ
কোন নারীর স্বামী বা তাহার পরিবারের কোন সদস্য যদি যৌতুকের দাবীতে আঘাত প্রদানের মাধ্যমে গুরুতর জখম বা আঘাত প্রদান করেন তাহা হইলে অত্র ধারায় মামলা দায়ের করা যায়। অত্র ধারার অভিযোগ প্রমানিত হইলে আসামীগন যাবজ্জীবন কারাদন্ড অথবা সর্বোচ্চ ১২ (বারো) বছর ও সর্বনিন্ম ৫ (পাচ) বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হইবেন এবং উক্ত দন্ডের অতিরিক্ত অর্থদন্ডে দন্ডিত হইবেন।
১১(গ) যৌতুকের দাবীতে সাধারন আঘাত/ মারধর করাঃ
কোন নারীর স্বামী বা তাহার পরিবারের কোন সদস্য যদি যৌতুকের দাবীতে মারধর কিংবা সাধারন আঘাত করেন তাহা হইলে অত্র ধারায় মামলা দায়ের করা যায়। অত্র ধারার অভিযোগ প্রমানিত হইলে আসামীগন সর্বোচ্চ ৩ (তিন) বছর ও সর্বনিন্ম ১ (এক) বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হইবেন এবং উক্ত দন্ডের অতিরিক্ত অর্থদন্ডে দন্ডিত হইবেন।
অত্র ১১ ধারায় থানায় কিংবা বিজ্ঞ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্রুনালে মামলা দাযের করতে হয়। এবং এধরনের মামলার বিচার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী/২০০৩) মোতাবেক গঠিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্রুনাল বিচার করবেন।
অত্র আইনের ৩২ ধারা মোতাবেক এ ধরনের মামলায় অবশ্যই ভিকটিমের মেডিক্যাল সার্টিফিকেট বাধ্যতামুলক। তাই নির্যাতনের স্বীকার নারীকে নির্যাতন পরবর্তীতে নিকটস্থ সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহন করতে হবে এবং চিকিৎসা সনদ সংগ্রহ করতে হবে। এবং তা মামলা দায়েরের সময় সংযুক্ত করে দিতে হবে।
৩। পারিবারিক সহিংসতা ( প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ মোতাবেক মামলাঃ
যদি কোনো নারী পারিবারিক সহিংসতার স্বীকার হন তাহলে তিনি নিকটস্থ থানায় পুলিশ অফিসার (অফিসার ইনচার্জ), মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা কিংবা সরাসরি আদালতে তার সুরক্ষার জন্য মামলা দায়ের করতে পারবেন। এই আইনের মুল লক্ষ্য হলো সুরক্ষা নিশ্চিতকরন। আদালত একজন নারীর সুরক্ষার জন্য তার নিরাপদ বাসস্থান, ভরনপোষন, সম্পত্তির ভোগ দখলের নিশ্চয়তা সহ উপযুক্ত যেকোন আদেশ দিতে পারবেন। প্রতিপক্ষ এধরনের কোনো আদেশ অমান্য করলে তাকে ০৬ (ছয় মাস) কারাদন্ড, ১০,০০০/- টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড বা উভয়বিধ দন্ডে দন্ডিত করা যাবে। এবং কেহ যদি এধরনের অপরাধ পুনরায় করেন তাহা হলে ০২ (দুই) বছর পর্যন্ত কারাদন্ড ও ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড কিংবা উভয়বিধ দন্ডে দন্ডিত করা যাবে।
৪। দেনমোহরানা ও ভরনপোষন আদায়ের মোকদ্দমাঃ
একজন নারী তার বকেয়া দেনমোহরানা ও ভরনপোষন আদায়ের জন্য দি ফ্যামিলি কোর্টস অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৫ এর ৫ ধারা মোতাবেক সহকারী জজ ও পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করতে পারেন। এবং উক্ত আদালতই এই মামলার বিচার করবেন। স্বামী তার স্ত্রীর দেনমোহরানা ও ভরনপোষন আদায়ে বাধ্য। অনেকের মধ্যে এ ধারনা রয়েছে যে, কোন স্ত্রী তালাক দিলে আর দেনমোহরানা পাবেন না। ধারনাটি সঠিক নয়। দেনমোহরানা একজন নারীর অধিকার। তালাক স্বামী বা স্ত্রী যেই দেক না কেনো স্বামীকে অবশ্যই তার স্ত্রীর প্রাপ্য দেনমোহরানা আদায় করতে হবে। এবং স্ত্রীর ভরনপোষন আদায় করতে হবে। তবে তালাক হয়ে গেলে ইদ্দতকালীন ৩ মাসের ভরনপোষন দিতে হবে।
৫। নাবালকের ভরনপোষনের আদায়ের জন্য মোকদ্দমাঃ
একজন বাবাকে অবশ্যই সন্তানের ভরনপোষন আদায় করতে হবে। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় স্বামী স্ত্রীর মধ্যে তালাক হয়ে যায়। তখনও একজন বাবাকে তার সন্তানের ভরনপোষন নিয়মিত পরিশোধ করতে হবে। কোন বাবা যদি তার সন্তানের ভরনপোষন প্রদান না করেন তাহা হইলে বাবাকে বিবাদী করে দি ফ্যামিলি কোর্টস অর্ডিন্যান্স ১৯৮৫ এর ৫ ধারা মোতাবেক নাবালকের ভরনপোষন আদায়ের মোকদ্দমা করা যাবে।
৬। দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের মোকদ্দমাঃ
কোন যুক্তিসঙ্গত কারন ব্যাতিরেকে কোন স্বামী তার স্ত্রীর সহিত কিংবা কোন স্ত্রী তার স্বামীর সহিত একত্রে বসবাস কিংবা যৌনসঙ্গমে বিরত থাকতে পারবে না। যদি এরুপ করে তাহলে স্বামী বা স্ত্রী অপর পক্ষের বিরুদ্ধে পারিবারিক আদালতে দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের মামলা দায়ের করতে পারবে। তবে নিন্মলিখিত কিছু কারনে স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে আলাদা বসবাস বা যৌন সম্পর্ক হতে বিরত থাকতে পারেন। যথাঃ (ক) স্বামী যদি নিষ্ঠুর হয়। (খ) স্বামী যদি যৌনসঙ্গমে অক্ষম হয় কিংবা সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয়। (গ) দেনমোহরানা আশু পরিশোধ করা না হলে। (ঘ) স্বামীর সাথে মতের অমিল হলে আলাদা থাকতে পারবে এমন কোন চুক্তি বিবাহের সময় হয়ে থাকলে। (ঙ) স্বামী স্ত্রীর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দিলে। (চ) স্বামী সমাজচ্যুত হলে। ইত্যাদি।
৭। স্ত্রী কর্তৃক বিবাহ বিচ্ছেদের মোকদ্দমাঃ
১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন মোতাবেক একজন স্ত্রী ৯ টি কারনে বিজ্ঞ আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদের মোকদ্দমা দায়ের করতে পারেন। কারনগুলো হলোঃ-
(ক) ০৪ (চার) বছর পর্যন্ত স্বামী নিরুদ্দেশ থাকলে।
(খ) ০২ (দুই) বছর স্বামী স্ত্রীর খোরপোষ দিতে ব্যার্থ হলে।
(গ) স্বামীর ০৭ (সাত) বছর কিংবা তার বেশি কারাদন্ড হলে।
(ঘ) স্বামী যদি কোন যুক্তিসঙ্গত কারন ব্যাতিরেকে দাম্পত্য দায়িত্ব পালন করতে ব্যার্থ হয়।
(ঙ) স্বামী ০২ (দুই) বছর যাবত পাগল থাকলে কিংবা কুষ্টরোগে আক্রান্ত থাকলে কিংবা মারাত্বক যৌনরোগে আক্রান্ত থাকলে।
(চ) বিয়ের সময় পুরুষত্বহীন থাকলে এবং তা মোকদ্দমা দায়ের পর্যন্ত বিদ্যমান থাকলে।
(ছ) স্ত্রী উক্ত বিবাহটি অস্বীকার করলে। কোন মেয়ের অভিভাবকগন যদি ১৮ বছর হওয়ার পূর্বেই তাকে বিয়ে দেন এবং উক্ত সময়ে যদি তার স্বামীর সাথে যৌন সম্পর্ক না হয়ে থাকে তাহলে ১৮ বছর পূর্ন হওয়ার পর বিবাহ বিচ্ছেদ চাইতে পারেন।
(জ) স্বামী ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ আইনের বিধি লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত স্ত্রী গ্রহন করে।
(ঝ) স্বামী নিষ্ঠুর আচরন করলে। যেমনঃ
- যদি স্ত্রীকে শারিরীক বা মানষিক নির্যাতন করে।
- কুখ্যাত মহিলাদের সহিত মেলামেশা বা অনৈতিক জীবন যাপন করে।
- স্বামী যদি স্ত্রীকে নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত জীবন যাপনে বাধ্য করে।
- স্ত্রীর সম্পত্তি স্বামী হস্তান্তর করলে কিংবা স্ত্রীকে তার সম্পত্তির অধিকার হতে বঞ্চিত করলে কিংবা বাধা প্রদান করলে।
- স্ত্রীকে তার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানাদি পালনে বাধা দিলে।
- কোনো স্বামী যদি একাধিক স্ত্রী গ্রহন করেন তাহলে পবিত্র কুরআনের নির্দেশ মোতাবেক তাদের সহিত সমান ব্যাবহার না করলে।
উপরোক্ত মামলা সমূহ দায়েরের মাধ্যমে একজন নির্যাতিত নারী আইনের আশ্রয় পেতে পারেন।
আরোও জানুনঃ
মামলা থাকলে সরকারী চাকুরী হবে কি?
মামলায় কিভাবে সাজা বা খালাষ হয়?
চেক ডিজঅনার মামলা হলে করনীয় কি? কিভাবে পাবেন প্রতিকার
আইন বিষয়ে আরোও জানতে আমাদের ফেসবুক পেজ আইনের আশ্রয়ে মেজেস করতে পারেন।
পারিবারিক নারী নির্যাতনে কি কি মামলা করা যায়।